সৌমেন্দ্র গোস্বামীর গল্প: বিষ বৃত্তান্ত

জুন ১৭, ২০২৩ ০ comments deshgrampost Categories সাহিত্য ও সংস্কৃতি

বাবা অসুস্থ হওয়ার পর গ্রামের বাড়িটা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু স্কুলের জন্য হয়নি। রিটায়ারমেন্টের পর স্কুলটি নির্মাণ করেন বাবা। ঠাকুমার নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখেন ‘আনন্দময়ী সাংস্কৃতিক স্কুল।’

আট মাস হলো বাবা নেই। আকাশের তারা হয়ে গেছেন। আগে স্কুল নিয়ে আমাকে ভাবতে হতো না। বাবাই সবটা দেখতেন। এখন স্কুলের বিষয়েও অনির্বাণ কাকুকে সময় দিতে হয়। ভদ্রলোক বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক স্কুলের পরিচালক। আগে বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে স্কুলের ভালো-মন্দ সিদ্ধান্ত নিতেন। এখন প্রায় আমাকে ফোন করেন। স্কুলের প্রসঙ্গ ছাড়াও নানা বিষয়ে কথা হয়। কিন্তু কাকু যে হঠাৎ দেখা করতে আসবেন, ভাবতে পারিনি। বাবা বেঁচে থাকতে বহুবার আসার কথা বলেছেন। তিনি আসেননি। এককথা তার, ‘ট্রাফিক জ্যাম, ধুলো, মানুষের গিজগিজে ঠাসা শহর আমার ভাল্লাগে না। একদণ্ডও মন এখানে দাঁড়ায় না।’

নিজেকে সামলে যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। তারপর নানা কথা হতে হতে আলাপ জমে উঠল। একপর্যায়ে হঠাৎ আসার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন কাকু। একটা আবদার নিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্র উৎসবে আমাকে যেতে হবে। বাবা যেতেন, উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করতেন। কাকুর ইচ্ছা, এ বংশের উত্তরাধিকারের হাতেই স্কুলের প্রধান সাংস্কৃতিক আয়োজনের উদ্বোধন হবে। যতদিন দায়িত্বে আছেন, অন্যথা হতে দেবেন না।

আমি শুভাশিস কর্মকার। পেশায় ব্যবসায়ী। বয়স পঁয়ত্রিশ। বিবাহিত। সব মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। আজ এ মিটিং কাল সে মিটিং লেগেই থাকে। দম ফেলার ফুসরত পাই না। তারপরও কাকুর মুখের উপর ‘না’ করতে পারলাম না। আসলে কিছু মানুষ থাকে জীবনে যাদের জন্য, যাদের কথা ভেবে অনেক কঠিন কিছুও হাসিমুখে মেনে নিতে হয়। অনির্বাণ কাকুও তেমন। আমার জীবনে ভূয়সী অবদান তার। বাবার পর এই মানুষটার কাছেই সবচেয়ে বেশি ঋণী আমি। কেউ কেউ অতীতের কথা স্বীকার করতে লজ্জা পান। আমার সে সমস্যা নেই। নির্দ্বিধায় বলতে পারি।

সেদিন কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসেননি। বাবার বিন্দুমাত্র দোষ ছিল না। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দুর্নীতি সম্পর্কে জেনে গিয়েছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। হুমকি-ধামকি দিয়েও নিজেদের দলে ভেড়াতে না পেরে অফিস কলিগদের একাংশ ষড়যন্ত্র করে বাবাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল। বাবা নিরুপায়। কিছু করার নেই। সৎ-অসতের যুদ্ধ হলে অসতের পক্ষেই লোক বেশি হয়। নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত শুরু হলো। সেই সময় আমার স্কলারশিপ প্রায় চূড়ান্ত। নির্দিষ্ট টাকা জমা করার দিন ঘনিয়ে এলো। তদন্তের স্বার্থে মা-বাবার ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করা যাবে না। সম্পদ-সম্পত্তি বিক্রির উপরও ছিল নিষেধাজ্ঞা।

আত্মীয়-স্বজনদের প্রত্যেকে এবং তারাও যারা নিয়মিত বাবা-মায়ের কাছে হাত পাততেন, সবাই হাত গুটিয়ে নিলেন। শেষমেশ কোনো দিশা না দেখে অনির্বাণ কাকুকে সবটা জানালেন বাবা। বিনা বাক্য ব্যয়ে নিজের পৈতৃক ভিটা-মাটি বন্দক রেখে কাকু টাকার ব্যবস্থা করলেন। দেশের বাইরে যাব, চিন্তিত বিষণ্ন আমি। যন্ত্রণাময় যন্ত্রের মধ্যে বাবা-মাকে একা ফেলে কেমন করে যাই! সৃষ্টিকর্তা মহান। বিদেশে পাড়ি দেওয়ার আগেই ঝামেলা মিটে যায়। অসীম ক্ষমতা সত্যের, একদিন না একদিন সে-ই জয়ী হবেই। তার চেয়েও বড় কথা, হাজারো অসতের ভিড়ে একজন হলেও সৎ মানুষ থাকে। তেমনই দুই-একজন মানুষের বদান্যতায় তদন্তে দোষীদের শাস্তি হয়। সসম্মানে চাকরিতে যোগ দেন বাবা। কাকুকেও টাকা ফেরত দেওয়া হয়। সব আবার আগের মতো হয়ে যায়। কিন্তু কাকুর সেদিনের ঋণ, কোনো কিছুর বিনিময়েই কি শোধ করা সম্ভব! ইত্যাদি ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে ব্যবসায়িক ক্ষতি মেনে নিয়েই রবীন্দ্র উৎসবে যেতে রাজি হই।

২২ শ্রাবণ। পৃথিবীর বরপুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম/নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম।’ শিক্ষার্থীদের দলীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের পর্দা উঠল। আমার দুই চোখ জলে টলমল। কাকু কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘কাঁদে না। বাবার জন্য প্রার্থনা করো।’ প্রারম্ভিক বক্তৃতায় উপস্থিত গণ্যমান্যদের কেউ কেউ বললেন, ‘ছেলে একেবারে বাবার মতো হয়েছে। নীড় বিরাগী পাখির মতো সমুজ্জল সুন্দর মানুষ। চারদিকে যেন ওই সুন্দরের চাকচিক্যই ঠিকরে পড়ছে।’ কথাগুলো শুনে ভীষণ অপরাধী মনে হলো নিজেকে। ডাহা মিথ্যে কথা, মোটেই বাবার মতো হইনি আমি। এ প্রশস্তি আমার প্রাপ্য নয়।

মানুষের জন্য বাবার মন কাঁদতো। বাবা মানুষকে নিয়ে ভাবতেন। বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। তাছাড়া বাবা ব্যক্তিগত ডায়েরিতে একটি চিঠি লিখে গেছেন– ‘স্নেহাস্পদেষু সুজয়,

প্রত্যেক মা-বাবা সাধ্যমতো সন্তানকে তৈরি করার চেষ্টা করে। আমি আর তোমার মা-ও ব্যতিক্রম নই। আমরাও চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি কি পারিনি সে বিচার সময় করবে। শুধু এতটুকু খেয়াল রেখ, একজন মানুষও যেন তোমার দিকে আঙুল না তোলে। তোমাকে যেন কখনো মাথা নিচু করতে না হয়। শুধু উপদেশ দিতে ভাঙা ভাঙা অক্ষরে শেষ সময়ে চিঠি লিখছি না। আমার একটি স্বপ্ন তুমি পূরণ করবে। ধরে নিয়ো এটিই তোমার কাছে তোমার বাবার একমাত্র চাওয়া। হ্যাঁ, নিজেই কাজটা করে যেতে পারতাম, কিন্তু তুমি যদি অসন্তুষ্ট হও, জীবন সায়াহ্নে সন্তানের সঙ্গে মতবিরোধ হোক–এ আমি চাইনি। যা হোক, গ্রামে আমাদের যতটুকু যা আছে ভীষণ বিপদের দিনেও ওইদিকে নজর দিয়ো না। খাতা-কলমে না হলেও মন থেকে গ্রামের সমস্ত সব স্কুলের জন্য দিয়ে গেলাম। স্কুলটাকে তুমি বাঁচিও। নিজের জ্ঞান, দূরদর্শিতা দিয়ে সাজিও। অনির্বাণের যেন কখনো অসম্মান না হয়। সবাই যেন তোমাকে ভালোবাসে। আমি অতিদূর থেকেও যেন তোমার জয়ধ্বনি শুনতে পাই।’

যে চিঠির কথা কাউকে জানাইনি আমি। প্রায় বিষয়টা নিয়ে ভাবি, বাবা নিজে খাতা-কলমে কেন কাজটি করলেন না। দূরদর্শী মানুষ, সন্তানকে চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, অর্থ উপার্জনের নেশায় মানুষ হওয়ার সমীকরণে এক্স-ওয়াই-জেড যে কোনো একটি চলকের মান অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। আমি পুরোপুরি মানুষ হয়ে উঠিনি। আমার জীবনের অনেকটাই রয়ে গেছে ফাঁকি।